নাম থেকেই বুঝতে পারছেন এই সঞ্চয়পত্র পাঁচ বছর মেয়াদি। তবে আপনি পাঁচ বছরের আগে যদি দরকার পড়ে তাহলে ভাঙাতে পারবেন কিন্তু সর্বোচ্চ মুনাফা পাবেন না। হ্রাসকৃত হারে মুনাফা পাবেন। আর বিনিয়োগ করার এক বছরের মধ্যে যদি ভাঙিয়ে ফেলেন তাহলে শুধু আসল টাকা পাবেন, কোন মুনাফা পাবেন না। তাই আপনি বিনিয়োগ করার আগে নিশ্চিত হয়ে নিন আপনার আগামী পাছ বছরের মধ্যে বিনিয়োগকৃত টাকা উত্তোলনের প্রয়োজন আছে কিনা। যখন আপনি নিশ্চিত হবেন আপনার আগামী পাছ বছর বিনিয়োগকৃত টাকা নগদায়ন করার দরকার হবে না তখন আপনি পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন।
এই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কী আপনার জন্য উপযুক্ত?
সকল শ্রেণি ও পেশার বাংলাদেশি নাগরিক এই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনার যদি কোন লক্ষ্য থাকে যে আপনি পাঁচ বছর পর এই বিনিয়োগকৃত টাকা দিয়ে কোনো একটি কাজ করবেন তাহলে আপনি এই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। আপনি পাঁচ বছর পর একটা ফ্ল্যাট/প্লট বুকিং দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু এখন আপনার কাছে ফ্ল্যাট/প্লট বুকিং মানি/ডাউনপেমেন্ট নেই। পাঁচ বছর পরে আপনি এই বিনিয়োগকৃত টাকা থেকে মুনাফাসহ যে টাকা পাবেন তা দিয়ে ডাউনপেমেন্ট দিতে পারবেন তাহলে এই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আপনার জন্য উপযোগী। আবার আপনার হাতে এখন কিছু টাকা আছে। আপনি আগামী কয়েক বছর পর আরও কিছু টাকা জমিয়ে নিজের একটা ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন। তাহলেও আপনি এই খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন। আর আপনি যদি অবসরকালীন সেভিং করতে চান তাহলেও এই সঞ্চয়পত্র আপনার জন্য উপযোগী।
কত পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন?
আপনি ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো টাকার জন্য বিনিয়োগ করতে পারবেন। তবে একক নামে ৩০ লাখ বা যৌথ নামে ৬০ লাখ বিনিয়োগ করা যাবে।
বিনিয়োগ করার জন্য কোথায় যোগাযোগ করবেন?
জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক শাখাসমূহ, তফসিলি ব্যাংকসমূহ এবং ডাকঘর থেকে ক্রয় ও নগদায়ন করতে পারবেন। সবচেয়ে ভালো হয় আপনার যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে প্রথমে ওই ব্যাংকে যোগাযোগ করুন। যদি ওই ব্যাংক সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে তাহলে আপনার জন্য সুবিধা। কারণ আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে খুব সহজেই সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। এবং মেয়াদান্তে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আসল এবং মুনাফার টাকা জমা হয়ে যাবে। এতে করে সঞ্চয়পত্র ক্রয় এবং নগদায়নের সময় বাড়তি ঝামেলা করতে হবে না। আর আপনার যে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে ওই ব্যাংক যদি সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করে তাহলে কোন ব্যাংক সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে তা জেনে নিন। সাধারণত, যে ব্যাংক থেকে আপনি সঞ্চয়পত্র কিনবেন ওই ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। এবং তারপরেই আপনি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। আপনি যদি গ্রামে থাকেন এবং কাছাকাছি যদি ব্যাংক না থাকে তাহলে আপনি ডাকঘর থেকে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। এবং মেয়াদান্তে ওই ডাকঘর থেকেই নগদায়ন করতে পারবেন।
বিনিয়োগ করার জন্য দরকারি কী কাগজপত্র লাগবে?
আপনি যখন ব্যাংক বা ডাকঘরে সঞ্চয়পত্র কিনতে যাবেন তখন জেনে নেবেন কী কী কাগজপত্র লাগবে। অবস্থান ভেদে কাগজপত্র কমতে বা বাড়তে পারে। তবে সাধারণত জাতীয় পরিচয়পত্র, টিআইএন, যাকে নমিনি দেবেন তার জাতীয় পরিচয়পত্র, বিনিয়োগকারী এবং নমিনির পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগে। আরেকটি বিষয় জেনে নিতে পারেন, দরকারি কাগজপত্র সত্যায়িত করতে হবে কিনা।
২০২২ সাল থেকে ৫,০০,০০০ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্রের ফটোকপি জমা দিতে হবে। আগে টিআইএন জমা দিলেই হতো। এখন থেকে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের প্রাপ্তি স্বীকারপত্র জমা দিতে হবে। ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স দেওয়ার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আপনার করযোগ্য আয় যদি করমুক্ত সীমা অতিক্রম না করে তাহলে আপনি খুব সহজেই মাত্র এক পৃষ্ঠার রিটার্ন ফরম নিজেই পূরণ করে জমা দিতে পারেন। এ জন্য আপনাকে কোনো কর দিতে হবে না।
বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন কেমন আসবে?
পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে কেমন রিটার্ন পাবেন তা নির্ভর করবে আপনার বিনিয়োগকৃত টাকা কত তার ওপর। বিনিয়োগকৃত টাকার সীমা অনুযায়ী তিনটি মুনাফার হার দেওয়া আছে। এই সীমা অনুযায়ী আপনার মুনাফার হার নির্ধারণ হবে। নিচে দেখে নিন বিনিয়োগ সীমা অনুযায়ী মুনাফার হার।
ক) ১৫,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত-১১.২৮%
খ) ১৫,০০,০০১ টাকা থেকে ৩০,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ১০.৩০%
গ) ৩০,০০,০০১ টাকা থেকে তদূর্ধ্ব-৯.৩০%
ধরুন আপনি মোট ৫০,০০,০০০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাহলে আপনি প্রথম ১৫ লাখ টাকার ওপর ১১.২৮% হিসেবে মুনাফা পাবেন, পরবর্তী ১৫ লাখ টাকার ওপর ৩০% হিসেবে মুনাফা পাবেন এবং অবশিষ্ট ২০ লাখ টাকার ওপর ৯.৩০% হিসেবে মুনাফা পাবেন।
যেহেতু এই সঞ্চয়পত্র পাঁচ বছর মেয়াদি তাই আপনি এই বিনিয়োগ থেকে পাঁচ বছর পর এক সঙ্গে আসল এবং মুনাফা পাবেন। এবং মুনাফা থেকে ১০% কর কর্তন করে বাকি টাকা আপনাকে পরিশোধ করবে।
সাধারণ বিনিয়োগকারী কেমন রিটার্ন পাবেন?
সাধারণ বিনিয়োগকারী বলতে যিনি করদাতা নন, অর্থাৎ যিনি ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করেন না এমন বিনিয়োগকারী। আপনি যদি সাধারণ বিনিয়োগকারী হোন তাহলে আপনি কেমন রিটার্ন পাবেন? এখানে ১,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করলে এক বছর পর কত রিটার্ন আসবে তা আমরা দেখব।
ধরে নিচ্ছি আপনি পাঁচ বছর আপনার সঞ্চয়পত্র রাখবেন। এবং আপনি ১,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাহলে আপনি এক বছর পর ১১.২৮% হিসেবে মুনাফা পাবেন।
এক বছর পর মুনাফার পরিমাণ (১,০০,০০০ X ১১.২৮%) = ১১,২৮০ টাকা।
কর কর্তন করবে (১১,২৮০ X ১০%) = ১,১২৮ টাকা।
কর কর্তনের পর আপনি পাবেন (১১,২৮০-১, ১২৮) = ১০,১৫২ টাকা।
যেহেতু পাঁচ বছর পর আপনি মুনাফাসহ আসল টাকা পাবেন তাই প্রতি বছর কিন্তু আপনার মুনাফার টাকা জমছে এবং এই মুনাফার ওপরও আপনি কিন্তু পরের বছরগুলোতে মুনাফা পাবেন। অর্থাৎ চক্রবৃদ্ধি হারে আপনি জমাকৃত টাকার ওপর মুনাফা পাবেন। পাঁচ বছর পর আপনি যখন মুনাফাসহ আসল টাকা পাবেন তখন শুধু মুনাফার ওপর কর কর্তন করা হবে। সকল শ্রেণি ও পেশার বাংলাদেশি নাগরিক ক্রয় করতে পারবেন। নমিনি নিয়োগ করা যায়। ক্রেতার মৃত্যুর পর নমিনি সঙ্গে সঙ্গেই অথবা মেয়াদ উত্তীর্ণের পর সঞ্চয়পত্র নগদায়ন করে নিতে পারেন।
করদাতা কেমন রিটার্ন পাবেন?
সাধারণ বিনিয়োগকারীর তুলনায় কর প্রদানকারী সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে রিটার্ন বেশি পান। যেই বছর করদাতা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবেন ওই বছর রিটার্নের পরিমাণ বেশি। এই রিটার্নটা দুই দিক থেকে হতে পারে। একটি হলো কর রেয়াত এবং আরেকটি হলো কোনো করদাতা যদি ১০% এর চেয়ে বেশি হারে কর দেন তাহলে তিনি চূড়ান্ত কর হিসেবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার ওপর ১০% হিসেবেই কর দিয়ে থাকেন।
ওপরের উদাহরণ থেকে জেনেছেন আপনি ১,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করে এক বছর পর ১০% কর কর্তনের পর ১০,১৫২ টাকা পাবেন। আর আপনি যেহেতু করদাতা তাই আপনি যে ১,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করেছেন তা বিনিয়োগ ভাতা হিসেবে দেখাতে পারবেন। আয়কর আইনে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কর রেয়াত সুবিধার জন্য বিবেচনা করা হয়। তাহলে আপনি যেই বছর বিনিয়োগ করেছেন শুধুমাত্র ওই বছরই এই ১,০০,০০০ টাকার ওপর ১৫% হিসেবে কর রেয়াত পাবেন। এই ১৫,০০০ টাকা আপনার করদায় থেকে বাদ যাবে। তাহলে এখানে আপনার ১৫,০০০ টাকা কর হ্রাস পেল।
একদিকে আপনি বিনিয়োগ করে প্রথম বছর ১০,১৫২ টাকা পেয়েছেন। আর অন্যদিকে কর রেয়াত সুবিধা পেয়েছেন ১৫,০০০ টাকা । তাহলে আপনার মোট রিটার্ন হলো ২৫, ১৫২ (১০,১৫২ + ১৫,০০০) টাকা। বুঝতে পারছেন করদাতার জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ খুবই লাভজনক। তবে আপনি যদি পাঁচ বছরের আগে এই বিনিয়োগকৃত টাকা নগদায়ন করেন তাহলে যে বছর নগদায়ন করেছেন ওই বছর যে ১৫,০০০ টাকা আপনি কর রেয়াত সুবিধা নিয়েছিলেন তা যোগ হয়ে যাবে। অর্থাৎ আপনার ১৫,০০০ টাকা কর রেয়াত সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে। তাই কর সুবিধা বহাল রাখার জন্য আপনাকে পাঁচ বছর এই সঞ্চয়পত্র ধরে রাখতে হবে।
এ ছাড়া যদি করযোগ্য আয়ের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে আরেকটি সুবিধা করদাতা পেতে পারেন, যা একটু আগে বলছিলাম চূড়ান্ত করের সুবিধা। যেমন, একজন করদাতার যদি ৯,০০,০০০ টাকা করযোগ্য আয় হয় তাহলে তিনি কীভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে বাড়তি লাভবান হতে পারেন তা চলুন নিচে দেখে নেই।
প্রথম ৩,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত ০% হিসেবে-
পরবর্তী ১,০০,০০০ টাকার ওপর ৫% হিসেবে-৫,০০০ টাকা
পরবর্তী ৩,০০,০০০ টাকার ওপর ১০% হিসেবে-৩০,০০০ টাকা
অবশিষ্ট ২,০০,০০০ টাকার ওপর ১৫% হিসেবে-৩০,০০০ টাকা
মোট ৯,০০,০০০ টাকার ওপর কর আসে ৬৫,০০০ টাকা।
এবং সঞ্চয়পত্রের মুনাফা ১১,২৮০ টাকার ওপর ১০% হিসেবে ১,১২৮ টাকা।
এ ক্ষেত্রে যদিও করদাতা সর্বোচ্চ ১৫% হিসেবে কর দিচ্ছেন কিন্তু সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে কর কর্তন চূড়ান্ত কর হওয়ার কারণে ১,১২৮ টাকাই কর। যদি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে কর কর্তন চূড়ান্ত করদায় না হতো তাহলে কিন্তু ১১,২৮০ টাকা ৯,০০,০০০ টাকার সঙ্গে যোগ হয়ে যেতো এবং এই টাকার ওপর ১৫% হিসেবে কর দিতে হতো, যা আসে ১,৬৯২ (১১,২৮০ × ১৫%) টাকা। আপনাকে বেশি দিতে হতো ৫৬৪ টাকা (১,৬৯২-১, ১২৮)। কর কম দিতে হলো ৫৬৪ টাকা। তার অর্থ দাঁড়ায় যে করদাতার আয় যত বেশি হবে ওই করদাতা তত বেশি কর সুবিধা পাবেন।
Related Word : সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম ২০২৩, অনলাইনে সঞ্চয়পত্র ক্রয় করার নিয়ম, ৫ বছর মেয়াদী বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, dps, সঞ্চয়পত্র মুনাফার হার, সরকারি সঞ্চয়পত্র, সঞ্চয়পত্র হেল্পলাইন, পরিবার সঞ্চয়পত্র,সঞ্চয়পত্র কিভাবে কিনবো, সঞ্চয়পত্রের খবর, বাংলাদেশ ব্যাংক সঞ্চয়পত্রের নতুন নিয়ম, সরকারি,post office fixed deposit, সঞ্চয়পত্র প্রজ্ঞাপন, fdr, অনলাইনে সঞ্চয়পত্র ক্রয়, সঞ্চয়পত্র নাকি এফডিআর, sanchayapatra rules, সঞ্চয়পত্র লোন,সঞ্চয়পত্র কেনার ফরম, সঞ্চয় স্কিম, সঞ্চয়পত্র মুনাফা ক্যালকুলেটর, জাতীয় সঞ্চয়পত্র অনলাইন, সঞ্চয়পত্র কোথায় পাওয়া যায়, banking, sonchypotro, sanchayapatra interest rate, sanchayapatra a to z,সঞ্চয়পত্র কি, সঞ্চয়পত্র কোথায় পাওয়া যায়