আত্মপরিচয়ের সুই সুতা মিশন ইসলাম । মুসলমানদের আত্মপরিচয় কি হবে ডা শামশুল আরেফিন

পোশাক ছোট বিষয় কথাটা অনেকেই বলেছেন। ইমাম আবু হানিফাও বলেছেন। সাহাবি ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকেও বর্ণিত। আহলুস সুন্নাহর চিন্তাগত ও কর্মগত বৈশিষ্ট্যগুলো এক কথায় উঠে এসেছে কওলটিতে :

• দুই শাইখকে শ্রেষ্ঠ মনে করা (আবু বকর ও উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুম) [শিয়ারা করে না]
• দুই জামাতাকে মুহাব্বাত করা (উসমান ও আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুম) [নাসেবীরা করে না]
•দুই কিবলাকে ইজ্জত করা (কা’বা ও কুদস) (ইহুদিরা করে না]
•দুই পদেরই জানাযা পড়া (নেককার ও ফাসিক) [খারিজিরাফাসিককে কাফির মনে করে, জানাযা পড়ে না]
•দুই ইমামের পিছেই নামাজ পড়া (নেককার বা ফাসিক) [খারিজিরা পড়ে না]

এভাবে বাতিল গোষ্ঠী থেকে নিজেদের আকীদা বিশ্বাসের অবস্থানকে আলাদা করা হয়েছে। এরকম অনেকগুলোর মাঝে একটা ছিল : ‘খুফফা বা মোটা মোজার (চামড়ার) ওপর মাসেহ করা’। [শিয়ারা মাসেহকে সঠিক মনে করে না। এটা আকীদার টপিক না, নিজ ‘অবস্থানের’ টপিক।

এটা আহলুস সুন্নাহ বা নাজাতপ্রাপ্ত দলের একটা খাসলত বা বৈশিষ্ট্য যে তারা বিশ্বাস করে, মোজার ওপর মাসেহ করলে ওজু হয়ে যায়। অথচ এটা কিন্তু মোটাদাগে আকীদার কোনো ইস্যু না। দ্বীনের একদম যাকে বলে ‘কম’ প্রায়োগিক একটা মাসআলা। পঁচানব্বই ভাগ মুসলিম জানেও না, জানার দরকারও হয় না। অনেকটা নদীমাতৃক বাংলাদেশে তায়াম্মুমের মাসআলার মতোই একটা ‘কালেভদ্রে লাগা’ বা এর চেয়েও বিরল একটা বিষয়। কিন্তু যখন অন্য কোনো গ্রুপের আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার বিষয় আসে, তখন এরকম একটা বিরল ‘ছোট’ ‘আমল’ও আকীদার পার্থক্য বুঝাতে সামনে আনতে হয়। শিয়া রাফিজিরা মনে করে মোজার ওপর মাসেহ বৈধ না। তাদের সাথে আমাদের পার্থক্য দেখাতে এই ‘ছোট বিষয়টা’ও হক-বাতিলের মাপকাঠি হয়ে গেছে। জরুরিয়াত না, আকীদার মতো আবশ্যক বিষয় না। কিন্তু ‘আত্মপরিচয়’ যখন উদ্দেশ্য, তখন এটা স্থান পেয়েছে খলিফার বৈধতা ও কিবলার স্বীকৃতির মতো বিরাট আকীদা ইস্যুর সাথে একই কাতারে। আত্মপরিচয়ের জন্য খুঁটিনাটি বিষয়ও সামনে চলে আসে। আনতে হয়। নইলে কোনটা আমি আর কোনটা তুমি, তা স্পষ্ট হয় না। নিজের অবস্থান, নিজের ঈমান-আকীদা স্পষ্ট করতে এমন খুঁটিনাটি বিষয় সামনে ‘আনতে হয়’।

কয়েকদিন আগে খুব আলোচিত একটা বিষয় ছিল কুয়েটে শেষ ক্লাসের দিন বিদায়ী ব্যাচের জুব্বা-রুমাল পরে ক্লাসে আসার বিষয়টা। গণমাধ্যম সোশ্যাল মাধ্যমে হৈহৈরৈরৈ। শেষ পর্যন্ত সো কল্ড লিবারেল ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তিস্বাধীনতার ফাঁপর নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও আমরা দেখলাম নোটিশ জারি করতে যে, এ ধরনের সংস্কৃতি-বিরুদ্ধা পোশাক পরা যাবে না। শার্ট-প্যান্ট পরিহিতা এক আপুকে দেখলাম। বাঙালি সংস্কৃতি শেখাতে।

যে পোশাকটা আমি জ্ঞান হবার পর থেকেই আমার নানাকে পরতে দেখেছি, দাদাকে দেখেছি। প্রতিদিন আমার ইমামকে দেখি পরতে, প্রথম কাতারে দাঁড়ানো নানা শ্রেণিপেশার বয়স্ক লোকেদের দেখেছি। স্কুলে আমার টিচারদের অনেককে দেখেছি। ইসলামিয়াত ছাড়া অন্যান্য সাবজেক্টের টিচারদেরও দেখেছি। প্রতি শুক্রবার শখ করেও অনেক প্রতিবেশীকে পরতে দেখেছি। আজ একজন শার্ট-প্যান্ট পরা নারীর মুখে শুনি, সেই পোশাকটা নাকি বাংলাদেশি কালচারের সাথে অস্বাভাবিক! আমি ৯০’স কিড। কেবল এক্স-ফাইলস আর ম্যাকগাইভার ছাড়া বাস্তবে আমি কোনো মেয়েকে শার্ট-প্যান্ট-কোট পরতে দেখিনি। আমাদের পাঞ্জাবি-জুব্বা-আঙরাখা পরার ইতিহাস তো শার্ট-প্যান্ট পরার ইতিহাসের চেয়ে পুরোনো। ঠিক কত শ’ বছর পরলে একটা পোশাক নিজ সংস্কৃতির পোশাক হয়? যতদিন ধরে আমরা শার্ট-প্যান্ট পরতে শিখেছি, তার চেয়ে আমাদের পাঞ্জাবি-জুব্বা-বোরকা পরার ইতিহাস কি বেশি প্রাচীন না?রবীন্দ্রনাথ রামমোহনদের পোশাক দেখেন তো কী? ব্রিটিশ আমলের শিক্ষিত মুসলিমদের ছবি সার্চ দিয়ে দেখেন তো, কী পরেছে তারা?

জুব্বা-পাগড়ি-টুপিকে অনেক প্র্যাক্টিসিং মুসলিমও ‘ইসলামি পোশাক’ বলতে নারাজ। অনেক ভাইয়ের মতে ইসলামি পোশাক বলে কিছু নেই, যেকোনো পোশাকই ইসলামি পোশাক, যদি তা ইসলামের শর্ত পুরো করে। ঠিক আছে মানলাম। কিন্তু নবিজি যে এই পোশাকটা পরেছেন ও পরতেন তা তো মিথ্যে না। সাহাবিরা, চার খলিফা এই পোশাকটা পরতেন, এটুকু তো ঠিক । উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো, আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় সনদপ্রাপ্ত লোকগুলোর পোশাক তো এটাই ছিল। জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশ তারকার পোশাক তো ছিল এটাই আহলে বাইতের পোশাক তো এটাই ছিল যুগে যুগে ইমাম, মুহাদ্দিস, মুজাহিদীন, মুসলিম সুলতান, বিজ্ঞানী সবার পোশাক কী ছিল?

আরবভূমি ছাড়া স্পেন থেকে কাশগড় পর্যন্ত যত অনারব মনীষীর ছবি-ভাস্কর্য দেখা যায়, দেখেন তো। অনারব মুসলিমদের পোশাকও তো এটাই পাওয়া যায় ইতিহাসে। আমাদের দাদা-নানা, ধার্মিক স্কুল টিচার, মসজিদের ইমাম- মুয়াজ্জিন, গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা, কী পরেন। ব্রিটিশরা মগজ খেয়ে দেওয়ার আগে কী পোশাক পরত শিক্ষিত মুসলিম সমাজ এই উপমহাদেশে ?

সেই পোশাকটাকে যখন কলকাতা-কেন্দ্রিক কৃত্রিম চাপিয়ে-দেওয়া কোনো কালচার ‘বিদেশি’ বলে ডিজ-ঔন করতে চায়, নোটিশ দিয়ে নিষেধ করে, মেমসাহেবকে দিয়ে টিটকারি করায়, তখন আমার অবুঝ মন আপনাদের কাছে একটা নীরব প্রতিবাদ আশা করেছিল । মেসির ফ্যান মেসির জার্সি পরে । বাংলাদেশ টিমের সাপোর্টার বাঘের ছবিওয়ালা টিম জার্সি পরে মসজিদে আসে রহমতের ফেরেশতা তাড়াতে। নিচে ফুলহাতা ওপরে হাফহাতা টি-শার্ট পরে বলিউড-ফ্যান। আমার আপনার নবিপ্রেম-সাহাবা-প্রেম, ইসলাম-প্রেম কি এখনো মেসি-ক্রিকেট-বলিউড প্রেমের পর্যায়ে পৌঁছায়নি না কি? নবি-সাহাবিরা অতটুকু ভালোবাসারও হকদার হননি, না কি? আমি ভেবেছিলাম, কুয়েটের ঘটনাটা আপনাদের হয়তো গায়ে লাগবে।

চলে যাই প্রথম কথাটায় । ধরে নিচ্ছি, ইসলামি পোশাক বলে কিচ্ছু নেই। নেই মানে নেই-ই। তারপরও যখন সেক্যুলার বাম হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি চ্যালেন্জ করে, তখন এই ছোট্ট অপাংক্তেয় বিষয়টাই আমার আকীদার ইস্যু, আত্মপরিচয়। আমার অবস্থান, আমার ঈমান-আকীদার স্পষ্টীকরণে এটা আর ছোট মামুলি নগণ্য নেই, এটা আমার ভালোবাসা, আমার সংস্কৃতি, আমার উম্মত-সত্তার পরিচয়, আলামত। হতে পারে অন্যসময় এটা বড় কিছু না, বা কিছুই না। কিন্তু এখন এটা অনেক কিছু। যখন তুমি আমার পরিচয়কে হুমকির মুখে ফেলছ, তখন আমি আরও জোরে গায়ে পেঁচিয়ে নেব আমার পরিচয়। তোমার ব্রিটিশ-আশ্রিত হিন্দু-তোষণের কৃত্রিম সংস্কৃতি যখন আমার হাজার বছরের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-প্রোথিত সংস্কৃতিকে চ্যালেন্জ করবে, তখন আমি নিলাম তোমার চ্যালেন্জ। যদিও এতদিন এটা আমার কাছে কিছু ছিল না, এখন এটা আমার ভালোবাসা। এটা আমার ভালোবাসার মানুষদের পোশাক। শত্রুর পোশাকের ভিন পরিচয়ের বিপরীতে এটা আমার পরিচয়, এবং আমি এটা ঔন করি। তাই আমি এটা ডিফেন্ড করি।

আমি ভেবেছিলাম, আপনারা হয়তো এটার প্রতিবাদ কমপক্ষে এভাবে করবেন। যারা পোশাকটাকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতেন, তারা মাঝে মধ্যে পরা শুরু করবেন। যারা মাঝেমধ্যে পরতেন, গায়রত থেকে অধিকাংশ সময় পরা শুরু করবেন। যারা অধিকাংশ সময় পরেন, তারা সবসময় পরা ধরবেন। যারা সবসময় পরেন, তারা পাগড়িসহ পরা শুরু করবেন। ভেবেছিলাম আমাদের গায়রতে লাগবে।

পোশাকের দর্শন আপনি হয়তো ভাবছেন আমি পোশাক নিয়ে বলছি। পোশাক নিয়ে বলার এত কী আছে? অথচ আমি কাপড় নিয়ে কথা বলছি না। পোশাক শুধু কাপড়টাকে বলে না। পোশাক আরেকটু বেশি কিছু। নিছক রুচি-পছন্দ বা নাজায়েষ তো না’ বলার দ্বারা অনেক কিছুই শেষ হয়ে যায় না। পোশাক একটা জীবন দর্শনের চিহ্ন। শার্ট-প্যান্ট যাদের পোশাক, সেই ইউরোপীয় লিওপোল্ড উইস (মোহাম্মদ আসাদ) যা বুঝলেন, বংশপরম্পরায় মুসলিম হয়ে আমরা তা বুঝি কি? উনি নিজেও সারাজীবন ইউরোপীয় পোশাকই পরেছেন। কিন্তু পোশাকের দর্শন নিয়ে যা বললেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ


সভ্যতা কেবল একটা শূন্যগর্ভ রূপ নয়, বরং সভ্যতা হলো একটি জীবন্ত উদ্যম। যখনই আমরা তার বাইরের রূপকে গ্রহণ করতে শুরু করি, তখনই তার অন্তর্নিহিত ধারা ও চলিষ্ণু প্রভাব আমাদের ভেতর কাজ করতে শুরু করে। এবং ধীরে অলক্ষ্যে আমাদের সমগ্র মানসিক প্রবণতাকে রূপ দিতে শুরু করে। এই অভিজ্ঞতার পূর্ণ উপলব্ধি নিয়েই রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যেকোনো লোক অপর জাতির অনুকরণ করে, সে হয় তাদেরই অন্তর্গত। এই বিখ্যাত হাদীস কেবল এক নৈতিক আভাসমাত্র নয়, এ হচ্ছে এক উদ্দেশ্যমূলক উক্তি যাতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে যে, কোনো অমুসলিম সভ্যতার বাইরের রূপ অনুকরণের ফলে মুসলিমদের ভেতর আত্মবিলোপ অবশ্যম্ভাবী।


এ ক্ষেত্রে ‘জরুরি’ ও ‘মামুলি’ কোনো পার্থক্য নেই। পোশাকের মতো ব্যাপারগুলো নিছক ‘বাইরের’ এবং মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক সত্তার ওপর এর কোনো প্রভাব নেই—এমন ভাবার চেয়ে ভুল আর কিছুই নেই। পোশাক-পরিচ্ছদ সাধারণভাবে একটা জাতির বিশেষ দিকে চালিত রুচির যুগ যুগব্যাপী বিকাশের পরিণতি। পোশাকের ফ্যাশন নির্ধারিত হয় সেই জাতির রুচিসংক্রান্ত ধারণা ও প্রবণতা হিসেবে। যেমন, আজকের দিনের ইউরোপীয় ফ্যাশন সম্পূর্ণরূপে ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিগত ও নৈতিক চরিত্রেরই অনুরূপ। ইউরোপীয় পোশাক পরিধান করলে যেকোনো মুসলিম অচেতনভাবে নিজের রুচিকে ইউরোপীয় রুচির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। এটা করতে গিয়ে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিগত ও নৈতিক সত্তাকে বিকৃত করে তোলে। সে নিজ জাতির সাংস্কৃতিক সম্ভাবনাকে অস্বীকার করে নিজের চিরাচরিত রুচি, সৌন্দর্যবোধের মান, পছন্দ-অপছন্দ। আর পরিধান করে বিদেশি সভ্যতার বৌদ্ধিক-নৈতিক ঊর্দি।


যদি কোনো মুসলিম ইউরোপীয় পোশাক, চাল-চলন, জীবনপদ্ধতি অনুকরণ করে, এর দ্বারা সে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রতি তার মানসিক আকর্ষণই প্রকাশ করে, বাইরে তার বিঘোষিত মতবাদ যা-ই হোক না কেন। কোনো বিদেশি সভ্যতার প্রাণবস্তুকে গ্রহণ না করে বুদ্ধিবৃত্তি ও সৌন্দর্যানুভূতির ক্ষেত্রে তার অনুকরণ করা বাস্তবে অসম্ভব। তেমনি আবার জীবন সম্পর্কে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অস্বীকারকারী কোনো সভ্যতার প্রাণবস্তুকে গ্রহণ করে তারপরও সৎ মুসলিম হিসেবে নিজের পরিচয় দেওয়া সমভাবেই অসম্ভব।


পোশাক ও নৈতিকতা লিওপোল্ড উইসের আলাপের মাঝে বোল্ড করা অংশটা আমি আরও বুঝতে চাইলাম। ইউরোপীয় পোশাকের সাথে ইউরোপীয় নৈতিকতা- রুচির কী সম্পর্ক। আশপাশে পোশাকের ট্রেন্ডের দিকে তাকালে দেখবেন, ক্রমশ মেয়েরা- ছেলেরা—আগে যা ভেতরে পরত, সেসব এখন বাইরে পরছে। টাইটস আমরা শীতের দিনে প্যান্টের ভেতরে পরতাম, এখন লেগিংস-জেগিংস নামে বাইরেই পরছে। জাঙ্গিয়ার রিবনটা দেখানোর জন্য প্যান্ট পরা হচ্ছে অনেক নিচে। গেঞ্জির হাতা হাফ-হাতা নেই। হাফ-হাতা আর স্যান্ডো গেঞ্জির মাঝামাঝি-ম্যাগি-হাতা। মানে, আমার দেহের আকার বুঝা না যাক, এটা ছিল পোশাকের একটা উদ্দেশ্য। এখন আর সেটা নেই, দেহের আকার বুঝাতে অন্তর্বাসই এখন হয়ে গেছে বহির্বাস। পশ্চিমে এসব শুরু হয়েছে আরও আগেই ।


বিংশ শতক অবধি, আজকের শার্ট ছিল পশ্চিমেও একটা অন্তর্বাস মেয়েদের যেমন শেমিজ, ছেলেদের তেমন শার্ট। ১৭শ শতকের ফ্যাশনে শার্টের কিছু অংশ দেখার ব্যবস্থা করা হতো, যেমন আজকে অন্তর্বাসের
কিছু অংশ দেখানো হয় । সুতরাং বেশি পোশাক থেকে কম পোশাকের যে যাত্রা, আমরা তাতে শামিল আছি। অন্তর্বাস দেখানো, এবং পর্যায়ক্রমে অন্তর্বাসকেই মূল পোশাক হিসেবে প্রতিষ্ঠার পশ্চিমা স্রোতেই আমরা
আছি। পশ্চিমা রুচি-প্রবাহের সাথেই আমরা আছি । পোশাকের আলাপ তো তোলাই যায় না। পোশাকের আলাপ উঠলেই

প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের মাঝেই কেউ কেউ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান। কেন পাঞ্জাবি-জুব্বা পরতে হবে? কখনো কি নিজেকে এই প্রশ্ন করেছেন, কেন আপনি শার্ট-প্যান্ট-গেঞ্জি পরছেন? যে যুক্তিতে পাঞ্জাবি-জুব্বা পরাকে তাচ্ছিল্য করছেন, একই যুক্তিতে শার্ট-প্যান্টও তো পড়ে যাচ্ছে। বরং পশ্চিমা দর্শন যারা অস্বীকার করেছে, তারা ব্রিটিশের পোশাককেও অস্বীকার করেছে (যাদের হুজুর বলে মার্জিনালাইজ করা হয়)। আর পশ্চিমা দর্শন যারা গ্রহণ করেছি আমরা লর্ড মেকোলের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে, তারা ব্রিটিশের পোশাককেও আপন করে নিয়েছি। পোশাকের সাথে মানসিক দাসত্বের এবং মানসিক স্বাধীনতার একটা সম্পর্ক আছে, তাই না?


আপনি দেখবেন, ওরা আমাদের এই পোশাকের ওপরই আক্রোশ দেখায়। হিজাব, নিকাব, বোরকা, দাড়ি, টুপি, পাঞ্জাবি। এগুলোকে ওরা ‘ইসলামের চিহ্ন’ হিসেবেই নিষিদ্ধ করে। অথচ আমরা এগুলোকে ‘মুসলিমের চিহ্ন’ হিসেবে মানতে চাই না। যা মুসলিমের ইসলামের ‘প্রকাশ’ সেগুলো এরা দেখতে পারে না। পলিটিক্স অব ড্রেসকোড বা সিম্বলিজম। বইমেলায় দাড়িটুপির আধিক্য দেখলে, স্কুল-কলেজে বোরকা-হিজাবের আধিক্য দেখলে সেক্যু-রাম-বাম হতাশ হয়, প্রেসার ফিল করে। এক পর্যায়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় স্টল বন্ধ করার মতো। যা আরও ভুলের দিকে ওদের ঠেলে দেয়। সুতরাং পোশাক তাকওয়ার মাপকাঠি না হতে পারে,
কিন্তু আইডেন্টিটি পলিটিক্সে পোশাকের ভূমিকা বিরাট বিরাট।


হিন্দুধর্মে সেলাই করা পোশাক নিষিদ্ধ ছিল। একটা সেলাই-ছাড়া কাপড় পুরুষরা পরত ধুতি হিসেবে, মেয়েরা পরত শাড়ি। আজও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেলাইযুক্ত কাপড় বর্জনের প্রথা দেখা যায়। মেয়েরা কেউ কেউ সেলাইবিহীন কাঁচুলি ব্যবহার করত। মধ্যযুগে মুসলিম অভিযানের পর সেলাই করা কাপড়ের চল শুরু। দীর্ঘ মুসলিম শাসনে এ এলাকার হিন্দু-মুসলিমের পোশাক হয়ে উঠে হাঁটু অবধি লম্বা জামা (আঙরাখা, এই পোশাকই পাবেন। রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, স্বামী বিবেক এঁদের সবার ছবি দেখুন। হাঁটু অবধি লম্বা জামা।


ঊনবিংশ শতকের শেষে যখন হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান হলো, তখন হিন্দুরা নিজেদের পোশাক মুসলিমদের থেকে আলাদা করার চেতনা অনুভব করল । ১৮৭৪ সালে রাজনারায়ণ বসু লিখছেন :


প্রত্যেক জাতিরই একটি নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ আছে। সেইরূপ পরিচ্ছদ সেই জাতির সকল ব্যক্তিই পরিধান করিয়া থাকেন। কিন্তু আমাদিগের বাঙালি জাতির (হিন্দু) একটি নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ নাই। কোনো মজলিসে যাউন, একশত প্রকার পরিচ্ছদ দেখিবেন, কিছুমাত্র সমানতা নাই। ইহাতে একবার বোধ হয়, আমাদের কিছুমাত্র জাতি-ত্ব নাই একই আক্ষেপ ঝরে পড়ছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কথায়ও, বাঙ্গালির (হিন্দুর) পোশাক অতি আদিম ও আদমিক। বাঙ্গালির কোনো পোশাক নাই বলিলেও চলে।

হিন্দু জমিদারদের স্বদেশী আন্দোলনের সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর মুসলিম পোশাক থেকে স্বাতন্ত্র্যসূচক হিসেবে বাঙ্গালিদের (হিন্দুদের) জাতীয় পোশাক প্রবর্তনে উদ্যোগী হন ধুতি-পাজামা ছোট পাঞ্জাবি পরার রীতি চালু করেন। অন্যদিকে পার্সি মেয়েদের মতো কুচি দিয়ে শাড়ি পরা, পেটিকোট, ব্লাউজ-এর চল শুরু করেন ভারতের প্রথম ICS অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, যা ব্রাহ্মিকা স্টাইল নামে পরিচিত ছিল। (১২) বিংশ শতকের প্রথমভাগে ভারতে বিত্তবান পার্সিরাই প্রথম শার্ট-প্যান্ট পরা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই চল বৃদ্ধি পায়।


সুতরাং শার্ট-প্যান্টের ইতিহাস টেনেটুনে দেড়শো বছর হতে পারে। বিপরীতে পাঞ্জাবি-জুব্বার (হাঁটু অবধি লম্বা জামা) ইতিহাস ৮০০ বছরের ইতিহাস । শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমাদের রুচি বদলে দেওয়াই হয়েছে
যেন আমরা ব্রিটিশ পণ্য কিনি। এই পোশাক আমাদের দাসত্বের ইতিহাস বহন করে। শুনতে কি পান?


ডিফেন্ড করতে হলে আসুন ‘আমাদের পোশাক’ ডিফেন্ড করি । দাসত্বের চিহ্ন ডিফেন্ড করে কি লাভ? ইসলামি ঐতিহ্যের ‘প্রকাশ’গুলো আরও বেশি আঁকড়ে ধরুন। আইডেন্টিটি পলিটিক্সে সিম্বল খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতটুকু এখন আছে, তার চেয়ে বাড়িয়ে দিন। দাড়ি ছোট থাকলে ছেড়ে দিন। শার্ট পরতে হলেও মাথায় টুপি রাখুন সবসময়। বাধ্য না হলে পাঞ্জাবি জুব্বা আপনায়ে নিন। ঔন করুন। সবকিছু কি ফরজ-ওয়াজিব করে দিতে হবে? ভেতর থেকে কিছু আসা দরকার না? পোশাক যে শুধু পরার জন্য পরার জিনিস না। পোশাকের দর্শন আছে। পোশাকের একটা সিম্বলিজম আছে। পোশাক কিছু কথা বলতে চায় । পোশাক জীবন্ত কিছু এটা যেদিন থেকে বুঝছি, সেদিন থেকে শার্টপ্যান্ট আর পরিনি।

error: Content is protected !!