সঞ্চয়পত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ? কর সুবিধা কেমন ? সঞ্চয়পত্র থেকে রিটার্ন কেমন আসবে ?

বিনিয়োগের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খাত হলো বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইস্যুকৃত সেভিংস সার্টিফিকেট বা সঞ্চয়পত্র। যেহেতু বাংলাদেশ সরকার এই সার্টিফিকেট ইস্যু করে তাই সুদসহ আসল ফিরে পাওয়া নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নিরাপত্তার দিকটা নিশ্চিত হওয়ার পর বিনিয়োগকারীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হলো বিনিয়োগ থেকে রিটার্নের পরিমাণ। কারণ একজন বিনিয়োগকারীর প্রধান উদ্দেশ্য হলো নির্দিষ্ট সময় পর সর্বোচ্চ রিটার্ন। এই দিক থেকেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত বিনিয়োগ খাত আছে তার মধ্যে তুলনামূলক সবচেয়ে বেশি রিটার্ন আসে সঞ্চয়পত্র থেকে।


জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সঞ্চয়পত্র সংক্রান্ত জাবতীয় বিষয় পরিচালনা করে থাকে। মোট চার ধরনের সঞ্চয়পত্র আছে। এবং সঞ্চয়পত্র ভেদে একজন বিনিয়োগকারী ১১% থেকে ১২% এর মতো মুনাফা পেয়ে থাকেন। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি মুনাফা এই খাত থেকেই আসবে। যেহেতু সঞ্চয়পত্র থেকে সবচেয়ে বেশি রিটার্ন আসে তাই প্রায়ই মিডিয়াতে এই নিয়ে লেখালেখি হয়। কিন্তু সঞ্চয়পত্র বিভিন্ন শ্রেণির ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর কথা বিবেচনা করে মুনাফার হার কমানো হয়নি। এবং আশা করা যায় মুনাফার হার যদি ভবিষ্যতে কমেও তাহলে বেশি হ্রাস পাবে না। তাই আপনি নিশ্চিত এবং নিরাপদ বিনিয়োগ আশ্রয়স্থল হিসেবে এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন।


একটু আগে বলছিলাম, বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত চার ধরনের সঞ্চয়পত্র বিদ্যমান আছে।
ক) পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র;
খ) তিন বছর অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র;
গ) পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং
ঘ) পেনশনার সঞ্চয়পত্র।


প্রথম দুই ক্যাটাগরির সঞ্চয়পত্রে সকল শ্রেণির বাংলাদেশি নাগরিক বিনিয়োগ করতে পারেন। আর বাকি দুইটি সঞ্চয়পত্র জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর কর্তৃক নির্ধারিত ব্যক্তি বিনিয়োগ করতে পারেন।


সঞ্চয়পত্র থেকে রিটার্ন কেমন আসবে ?

পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মুনাফা বিনিয়োগকৃত টাকার সঙ্গে প্রদান করা হয়। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্র এবং তিন মাস অন্তর মুনাফা ভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে তিন মাস পরপর মুনাফা প্রদান করা হয়। এবং পরিবার সঞ্চয়পত্রে প্রতি মাসে মুনাফা প্রদান করা হয়। যেভাবেই আপনাকে মুনাফা প্রদান করুক না কেন মুনাফা হিসাব করার পদ্ধতি প্রায় একই। পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে যেহেতু মেয়াদান্তে সকল মুনাফা প্রদান করা হয় তাই বছর শেষে আপনার মুনাফা জমছে। এবং এই জমাকৃত মুনাফার ওপর আপনি আবার চক্রবৃদ্ধি হারে মুনাফা পাবেন।


চারটি সঞ্চয়পত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১.৭৬% হিসেবে মুনাফা পাওয়া যায় পেনশনার সঞ্চয়পত্র থেকে তবে এই সঞ্চয়পত্র সবার জন্য উন্মুক্ত না। তারপর পরিবার সঞ্চয়পত্র থেকে ১১.৫২% মুনাফা পাওয়া যায় যা মহিলা এবং প্রতিবন্ধী ও ৬৫ বছর ঊর্ধ্ব পুরুষ ব্যক্তি ক্রয় করতে পারেন। পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে ১১.২৮% এবং তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১.০৪% মুনাফা প্রদান করা হয়। মাসিক, ত্রৈমাসিক বা মেয়াদান্তে যখনই আপনাকে মুনাফা প্রদান করা হোক না কেন আপনি প্রথমে মুনাফার হার দিয়ে সারা বছরের মুনাফা বের করবেন। তারপর ১২ মাস দিয়ে ভাগ করে মাসিক মুনাফা বের করবেন। এতে করে আপনি যেমন বছরে আপনার কেমন মুনাফা আসবে তা জানতে পারবেন। আবার তেমনি মাসিক মুনাফা কত আসবে তাও জানতে পারবেন।


তবে আপনি প্রথমে যে সঞ্চয়পত্র থেকে বেশি মুনাফা পাবেন ওই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করুন। আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করুন, সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেই মুনাফার হার কমে যায়। আর আপনি পেনশনার সঞ্চয়পত্র ছাড়া বাকি তিনটি সঞ্চয়পত্রে সমন্বিতভাবে একক নামে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। তাই সর্বোচ্চ মুনাফা যাতে পেতে পারেন সে জন্য প্রথমে প্রতিটি সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকা করে বিনিয়োগ করুন। পরে বাকি ৫ লাখ টাকা আপনি পছন্দ অনুযায়ী বিনিয়োগ করুন। আপনাকে যখনই কোনো মুনাফা প্রদান করা হবে তখনই আপনার মুনাফা থেকে উৎসে কর কর্তন করে বাকি টাকা প্রদান করবে।


কর সুবিধা কেমন?

আপনি যেকোনো বিনিয়োগই করেন না কেন করের সুবিধা সম্পর্কে জানাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কর আপনার আয় কমিয়ে দেয়। এখন, আপনি বলতে পারেন আমিতো কর দিই না বা রিটার্ন দাখিল করি না। তাই করের বিষয়টা আমার বিবেচনা না করলেও হবে। আসলে বিষয়টা এভাবে এড়িয়ে গেলে ভুল হবে। কারণ আপনি বিনিয়োগ থেকে যদি। সম্পূর্ণ রিটার্ন পেয়ে যান বা হ্রাসকৃত হারে কর প্রদান করার সুবিধা থাকে তাহলে ওই খাতেই আপনার বিনিয়োগ করা উত্তম।


আপনি ব্যাংকে ১,০০,০০০ টাকা বিনিয়োগ করে ১০,০০০ টাকা সুদ পেয়েছেন। এই সুদ থেকে ১,৫০০ টাকা কর কর্তন করে বাকি ৮,৫০০ টাকা আপনাকে প্রদান করেছে। কিন্তু আপনি যদি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন তাহলে ১,০০০ টাকা কর কর্তন করে বাকি ৯,০০০ টাকা আপনাকে পরিশোধ করবে। তাহলে এখানে আপনি ৫০০ টাকা বেশি পেয়েছেন। এ জন্য আপনি রিটার্ন দাখিল না করলেও কখনোই বিনিয়োগ বা সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে কর সুবিধার বিষয়টা এড়িয়ে যাবেন না।


আর আপনি যদি করদাতা হয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে অবশ্যই কর সুবিধার বিষয়টা সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। কারণ, কিছু খাত আছে যেসব খাতে আপনি বিনিয়োগ করলে একদিকে কর হার কম এবং অন্যদিকে ওই বিনিয়োগকৃত টাকার ওপর কর রেয়াত সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। আপনি এক সঙ্গে দুইটি সুবিধা ভোগ করতে পারছেন।


সঞ্চয়পত্র হলো এমনি একটা বিনিয়োগ খাত। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ থেকে যে সুদ পেয়েছেন তার ওপর ১০% কর কর্তন করে আপনাকে বাকি টাকা পরিশোধ করবে। এবং এই কর কর্তন চূড়ান্ত করদায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর সুবিধা হলো, আপনার নিয়মিত খাত থেকে যে আয় হয়েছে তার ওপর আপনি ১০% এর বেশি হারে কর দিলেও সঞ্চয়পত্রের সুদ থেকে যে কর কর্তন করে রেখেছে তাই আপনার কর। আপনাকে আর নিয়মিত হারে কর দিতে হবে না।


যেমন, আপনি চাকরি করেন এবং আপনার করযোগ্য আয় হলো ২০,০০,০০০ টাকা। তাহলে কর ধাপ অনুযায়ী আপনি সর্বোচ্চ ২৫% হারে কর দিয়ে থাকেন। যদিও আপনি সর্বোচ্চ হারে কর দিচ্ছেন কিন্তু আপনি সঞ্চয়পত্র থেকে যে মুনাফা পেয়েছেন তার ওপর আর বাড়তি কর দিতে হবে না। যা কর্তন করেছে তাই আপনার কর। তাহলে লক্ষ্য করুন এখানে আপনার করদায় কমল। তবে যারা কর হার ১০% বা এর নিচে বা রিটার্ন দাখিল করেন না তারা এই সুবিধা ভোগ করতে পারবেন না। যে কর কেটে রাখা হয়েছে তা আপনার খরচ হিসেবে চলে গেল। আপনার আয় কমে গেল।


যেসব করদাতার করযোগ্য আয় বেশি তারা হ্রাসকৃত হারে কর সুবিধা ভোগ করার পাশাপাশি কর রেয়াত সুবিধাও পেয়ে থাকেন। তবে এই কর রেয়াত সুবিধা সকল করদাতাই ভোগ করতে পারেন। তাই কর রেয়াত সুবিধা পাওয়ার জন্য সকল করদাতার জন্য সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ একটি উত্তম খাত। আপনি প্রাথমিকভাবে জানলেন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে আর্থিকভাবে কেমন লাভবান হবেন। কিন্তু যে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে তার মধ্যে কোন সঞ্চয়পত্র আপনার জন্য উপযুক্ত?

error: Content is protected !!