সেকালের (-৭০, -৮০-এর দশকে বা তারও আগে যাদের জন্ম হয়েছে) বাবা- মায়েদের সন্তান লালনপালন সম্পর্কে তেমন পদ্ধতিগত বা অ্যাকাডেমিক জানা শোনা ছিল না, অর্থাৎ কীভাবে সন্তানকে বড় করতে হবে, পড়াশোনা করাতে হবে, কী খাওয়াতে হবে, কার সাথে মিশতে হবে—এসব নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা ব্যক্তিগত পর্যায়েও খুব বেশি সচেতনতা ছিল না। আমাদের পিতামাতারা শিক্ষায় এবং অর্থনৈতিকভাবেও অনেক পিছিয়ে ছিলেন। কিন্তু তারপরও দেখা যায় সেইসব পরিবার থেকে অনেকেই দায়িত্ববান এবং সুসন্তান (ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সুসন্তান বলতে যে সন্তান দায়িত্ববান এবং আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধাশীল) হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, আমার আম্মার পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত, আব্বা কলেজ থেকে বি.কম পাশ করে সরকারি ছা-পোষা চাকরি করতেন। অল্প বেতনে আমাদের নয় সদস্য-বিশিষ্ট পরিবার (চার ভাইবোন এবং চাচাতো ভাইবোন মিলে) চলত। শুধু অন্ন ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করতেই আব্বাকে সবসময় চিন্তায় অস্থির থাকতে দেখেছি। পড়াশোনা নিয়ে আব্বা এত সচেতন ছিলেন না, শুধু খেয়াল রাখতেন—আমরা ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছি কিনা। তিন ভাইয়ের দুজন ইঞ্জিনিয়ার আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/গবেষক (এদের দুজন আবার পিএইচডি করেছেন)। সবাই সুসন্তান হিসেবে যার যার পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমাদের দেশে এরকম ঘটনা অহরহ দেখা যায়, এমনকি নিরক্ষর এবং দরিদ্র পরিবার থেকেও অনেকে সুসন্তান হয়েছেন। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা তাদের সফল মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে বাধা তৈরি করেনি।
এখন ঘরে ঘরে শিক্ষিত ও জ্ঞানী যোগ্য পিতামাতা, এবং তারা অর্থনৈতিকভাবেও যথেষ্ট সচ্ছল, কিন্তু সেই তুলনায় তাদের সন্তানদের মাঝে দায়িত্ববান হয়ে ওঠার হার তেমন আশাপ্রদ নয়। তাহলে মূল সমস্যা কোথায়?
আগের দিনে সন্তান বেড়ে ওঠার জন্য সহায়ক সামাজিক পরিবেশ ছিল, যেখানে মানবীয় মূল্যবোধের চর্চাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হতো, অর্থাৎ ভ্যালু বেইজড সোস্যাইটি ছিল। তখন অনেক চ্যালেঞ্জ (যেমন: খাবারের কষ্ট, যাতায়াতের কষ্ট, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি) থাকলেও সেই প্রতিকূলতা গুলো দায়িত্বশীল এবং যোগ্য মানুষ তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। সেসময় সন্তানরা পিতামাতার ত্যাগ, পরিবারের অভাব-অনটনকে অনুধাবন করত, যা তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হতে ভেতর থেকে অনুপ্রাণিত করত।
আগের দিনে সন্তান লালন-পালনে সমাজ এগিয়ে আসত, দায়িত্ব নিত, তখন সমাজের ‘চোখ’ বলে একটি ব্যাপারও ছিল। যেমন: সে-সময়ে উঠতি বয়সে যারা ধূমপান করত, তারা তা লুকিয়ে করত। পাড়ার প্রতিবেশী আঙ্কেল-আন্টিকে আমরা খুব সমীহ করতাম। পিতামাতারাও তাদের ফিডব্যাক বা পর্যবেক্ষণকে খুব গুরুত্ব দিয়ে সন্তানকে শাসন করতেন। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক পরিবেশটা এতটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে এবং এত দ্রুতগতিতে সবকিছু পাল্টাচ্ছে যে, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আজকাল প্রবলভাবে দৃশ্যমান।
এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের সামনেও দৃষ্টিকটুভাবে ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে ধরে থাকতে দেখা যায়, এমনকি পাবলিক প্লেসে চুমু দিতেও কারও কোনো সংকোচ বা বিবেকবোধ কাজ করে না। আরও খারাপ লাগে, যখন দেখি বাহ্যিকভাবে ইসলামি পোশাক পরিহিতারাও অপসংস্কৃতিকে বরণ করে নিচ্ছে, তাদের মধ্যেও নেই তেমন পাপবোধ।
শিক্ষকরা দেখছেন, কিন্তু কেন জানি আগের দিনের বয়োজ্যেষ্ঠদের মতো সরাসরি বলতে সাহস পাচ্ছেন না, অর্থাৎ সেই আবহ এখন উঠে গেছে। শিক্ষকরা শুধু আফসোস করেন। আমার ভয় হয়—এই অবস্থা চলতে থাকলে বেশি ভুক্তভোগী হবে আমাদের সমাজের নারীরা। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এখন ভিডিও সহজেই ভাইরাল হয়ে যায়, বিশেষ করে মন্দ জিনিস বাতাসের বেগে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি কোনো স্বাভাবিক পিতামাতা তাদের সন্তানদের এমন হাল দেখতে চাইবেন না।
বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে পাবলিক প্লেসে স্বাভাবিক শালীনতা বজায় রাখতে যাদের ন্যূনতম বিবেচনাবোধ কাজ করে না, ড্যামকেয়ার অ্যাটটিটিউ দেখায়, তাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে (পরিবার এবং চাকরি) আশানুরূপ সাফল্য পাওয়ার কথা নয়। যেকোনো সফলতার মূলে কাজ করে শৃঙ্খলাবোধ। যারা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, তাদের ক্যারিয়ার এবং পরিবার গঠনে বাধার সম্মুখীন হওয়ার কথা। বর্তমান সময়ে আবহমান কাল থেকে গড়ে ওঠা সেই ‘সমাজের চোখ’ হারিয়ে গেছে।
সেকালে ধর্ম-কর্ম পালনকারীদের (যেমন: সালাত আদায়কারী, হিজাবধারী ইত্যাদি) সংখ্যা কম থাকলেও, অর্থাৎ এখনকার মতো বাহ্যিক (ভিজিবল) দিকটা ততটা বেশি না থাকলেও বয়োজ্যেষ্ঠরা সামাজিক মূল্যবোধ বা ভ্যালুজ-সংক্রান্ত বিচ্যুতি হলো কিনা, তা নিয়ে সচেতন ছিলেন।
বর্তমানে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা এবং ভোগ্য পণ্যের প্রাচুর্যতার ফলে নিজেকে সংযত করার মানসিকতা কমে গেছে, অর্থাৎ আমাদের সমাজে মানুষের মাঝে আত্মসংযমের দক্ষতায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিষয়টি সহজে অনুধাবনের জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন: কারও পাঁচ সেট পোশাক হলে ভালোভাবে প্রয়োজন মিটে যাওয়ার কথা, কিন্তু সে ৫০ সেট পোশাক কিনে আলমারি ভর্তি করে রেখেছে। এটি মূলত যতটুকু না প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি হলো অন্যকে দেখানো বা আমার অনেক জমা আছে—এই ধরনের একটি মানসিকতা। আবার ধরুন, কারও এক প্লেট খাবার হলেই চলত, কিন্তু সে বিভিন্ন আইটেমের ১০ প্লেট খাবার অর্ডার দিয়ে বসল, সে আসলে এক প্লেট খাবারই খায়, কিন্তু বাকিগুলো একটু চেখে নষ্ট করে। একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন—আগে মানুষেরা সাধারণ রেস্টুরেন্টে খেয়ে তৃপ্তি পেত। কিন্তু এখন ফাইভ স্টার হোটেলে খেতে না পারলে, অথবা নতুন মডেলের আইফোন কিনতে না পারলে তারা অনেকেই নিজের জীবনটাকে ব্যর্থ ভাবা শুরু করে। মোদ্দাকথা, আমাদের থেকে আত্মসংযম করার অভ্যাস উঠে গেছে, আমরা ক্রমশ ভোগবাদী তথা কনজিউমা বিজয় মানসিকতার দিকে ঝুকে পড়ছে।
আমাদের বাবা-মায়েদের সময়কার চ্যালেঞ্জগুলো ছিল মূলত শারীরিক (hardship), কিন্তু এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানসিক। মনের ইচ্ছা তথা ভোগবাদী মানসিকতার ওপর ভিত্তি করেই পুরো বিশ্বের সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যেখানে ইসলাম ধর্ম পালনকারীরাও সেই লাইফস্টাইল বেছে নিচ্ছে।
মানসিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন। তাই দেখা যাচ্ছে—অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানে এগিয়ে থাকলেও অনেক বছরের নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ থেকে তারা বিচ্যুত। মনের ইচ্ছাকে তৃপ্ত করার প্রয়াসে গড়ে উঠেছে মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের বিজনেস, যেমন: গনগাফি ডিজিটাল মিডিয়া, প্রসাধনী সামগ্রী। শুধু তা-ই নয়, মেয়েদের স্তনের আকার বড় করতে গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ১০ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি, এমনকি মেয়েদের গোপন অঙ্গ যো/নি/কে আকর্ষণীয় করতেও (labioplasty) গড়ে উঠেছে বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি৷ নতুন নতুন জীবনদর্শন, যেমন: এ*জি*টি বা ট্রা*জে*রে* ব্যানারেও গড়ে উঠছে সে*য়া* রি-কন্সট্রাকশন সার্জারি এবং হরমোন থেরাপির মতো বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি।
আত্মসংযম বা সেলফ-কন্ট্রোলের অভাবে বর্তমান সময়ের মানুষজন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। যার কারণে তৈরি হয়েছে ভোগবাদী মানসিকতা তথা আত্মকেন্দ্রিকতার সমাজব্যবস্থা। তাই আগের দিনে সন্তান লালন পালনের যে সামাজিক সাপোর্ট বা সহযোগিতা ছিল, তা থেকে বর্তমানের পিতামাতারা বঞ্চিত। এ যুগের সন্তান প্রতিপালনের বোঝা বা চ্যালেঞ্জ একমাত্র পিতামাতাকেই বহন করতে হয়, কেননা আগের দিনের মতো সমাজ আর এগিয়ে আসে না।
নীতি-নৈতিকতা, আত্মসংযম, ব্যক্তিসত্তা তৈরি হয় কৈশোরে মস্তিষ্ক বিকাশের মাধ্যমে। এই মূল্যবোধগুলো যদি সঠিক সময়ে বিকশিত না হয়, তবে তা পরবর্তী সময়ে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন বা প্র্যাক্টিস করা অনেক দুরূহ ব্যাপার। আমাদের সন্তানদেরকে লক্ষ্য করে ভোগবাদী বাণিজ্য-ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, যে সম্পর্কে আমাদের দেশের পিতামাতারা অন্ধকারে রয়েছেন। পরবর্তী পরিচ্ছেদে সন্তান প্রতিপালনে বর্তমান সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালঞ্জের ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়েছে।
চ্যালেঞ্জিং পারবেশে শিশুর বিকাশ এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে বিশ্বে এই বিষয়গুলো নিয়ে যত গবেষণা হয়, সেগুলোর প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা। এখানে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, আত্মসংযম, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা এই বিষয়গুলো বর্তমানের বিজ্ঞান গবেষণা ও চর্চার অংশ নয়।
মুসলিম হিসেবে আমরা পিতামাতারা চাই—আমাদের সন্তান এবং তাদের বংশধররা যেন পার্থিব ও পার লৌকিক সাফল্য অর্জন করে। তাই মনে যা চায়, তা আমরা করতে পারি না। মুসলিম হিসেবে আমাদের সুনির্দিষ্ট জীবনব্যবস্থা রয়েছে, যেখানে আত্মসংযমকেই মূলত লালন করা হয়।
এই প্রেক্ষাপটে একটি বিখ্যাত গবেষণার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। এটি হচ্ছে সুবিখ্যাত Standford Marshmallow experiment, যেখানে দেখা গিয়েছে যারা তাৎক্ষণিক তুষ্টির (Immediate gratification) বদলে বিলম্বিত তুষ্টিকে (Delayed gratification) পছন্দ করে, তারা জীবনের মোটামুটি সবক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে এবং সফল হয়। এটি ৪০ বছরব্যাপী পরিচালিত একটি গবেষণা। এই গবেষণা থেকে আরও যে বিষয়টি উঠে এসেছে, তা হলো—ধৈর্য বা আত্মসংযম গুণটি কিছুটা জন্মগত হতে পারে, কিন্তু বেশিরভাগই শেখা যায় (learned skill)। শেখার জন্য শৈশব এবং কৈশোরকালের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রত্যেক পিতামাতার সুযোগ রয়েছে সন্তানকে আত্মসংযম শেখানোর।